সকাল সাড়ে নয়টা। এখনও চোখে ঘুমের আভাস। দরজায় কে যেন ঠক ঠক করছে। চোখে ঘুমের আভাস নিয়েই বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলল হাসান।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাস করে একটা শব্দ অনুভূত হলো তার কানে। বুঝতে বেশি দেড়ি হল না যে কেউ একজন তাকে চড় মেড়েছে। তৎক্ষণাৎ ঘুমের
আভাসটা কাটতেই চোখে ধরা দিলো এক ভয়ঙ্কর-বিমূর্ত চেহারা। রাগ করে দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় থপাস। কিছুক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়ল কেন
তার বড় ভাই আলোর গতিতে তার গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিয়েছে। গতকাল রাত একটার দিকে মিমি নামের এক অপরিচিত মেয়েকে সে তার ভাইয়ের
ব্যাপারে কিছু কটু কথা বলেছি। এখন সে বুঝতে পাড়ল সেটা ছিল তার বড় ভাই হোসেনেরই ফেক আইডি।
সব রাগ চেপে-চুপে বস্তায় কোনঠাসা করে রেখে সে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করল। তার মন বারবার বলছিল আজ মনে হয় দিনটা ভালো যাবে না। প্রতি সপ্তাহের
শুক্রবারের মত আজও বন্ধুমহলে যেতে হবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। বন্ধু না বলে তাদের সমালোচক বলাই ভালো।
আড্ডাঘরে গিয়ে হাসি-ঠাট্টার পাত্রে পরিণত হলো সে। সবাই তাকে বেকুববেটর বলে সম্বোধন করে হাসছিল। তখন হাসানের মনে পড়ল হায়রে কেমন করে
আমার আইডিয়ার কথা তাদের কানে পৌছাল? এই কথা যে তার সহযোদ্ধা মুনির রটিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজ দায়িত্বে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা
ফুটানোর ব্যার্থ চেষ্টার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একটা ইনকিউবেটর তৈরি করবে। তার আইডিয়া অনুযায়ী একটা কার্ডবোর্ডের তৈরি ইনকিউবেটরে কয়েকটি নিষিক্ত ডিম
রাখে। ঠিক ২১ দিন পর প্রবল উৎসাহ ভরা উত্তেজনা নিয়ে ডিম থেকে বের হওয়া বাচ্চা দেখতে গেল। হতাশা ভরা মন নিয়ে দেখল ডিমগুল প্রায় সিদ্ধ হয়ে গেছে।
আর এ বিষয়টাই মুনির সবাইকে বলেছিল।
হাসানের একটা সুন্দর ডাকনাম আছে, তা হলো পাসান। পাসান হলো পাগলা হাসানের সংক্ষিপ্ত রূপ। তার মাথা থেকে বের হওয়া উদ্ভট আইডিয়া আর
কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্নের জন্য তার বন্ধুবান্ধব ও এলাকার গন্যমান্য সমালোচকবৃন্দ তার এই অদ্ভুদ নামকরণ করেছে।
আড্ডা থেকে করলার ইয়াম্মি জুসের মতো মন নিয়ে বাসায় ফিরে এলো হাসান। বিকেলটা মুভি দেখেই কাটিয়ে দিল। মুভিটা মজাদার হলেও তার কাছ থেকে
মজাটা হারিয়ে গিয়েছিল। কারণ তার মাথায় হঠাৎ এসেছিল সেই পুরনো সক্রেটিসের প্যারাডক্স। সক্রেটিস বলেছিল, আমি শুধু একটি কথাই জানি, তা হলো
আমি কিছুই জানি না। এর মধ্যকার কোন খন্ডাংশটি সত্য সেটা বের করতেই তার কালঘাম ছুটলেও সে এবারেও ব্যার্থ।
আজ শনিবার। স্কুলের ফোর্থ প্রিয়ড নাজুবুল্লাহ স্যারের। মাঝে মাঝে টিফিন টাইমেও ক্লাস করতে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। নাজিবুল্লাহ স্যার ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষক।
হাসান কোনো অবাঞ্চিত প্রশ্নের বাঞ্ছিত উত্তর পায় না এই স্যারের কাছে থেকে। তাই সাধারণ ভাবেই হাসানের কাছে নাজিবুল্লাহ স্যার বিরক্তিকর,নাজিবুল্লাহ স্যারে কাছে হাসান । হাসানের
প্রশ্নগুলো এইরকম -
সূর্য মহাকাশে থাক্লেও মহাকাশ কেনো ঘুটঘুটে অন্ধকার? সাদা আলোতে সাতটি রঙ থাকলেও
আকাশ কেন নীল রঙের? আনবিক দিক থেকে কাচ কঠিন, তরল বা বায়বীয় না হলেও ত্রিমাত্রিক দিক থেকে কেন কঠিন? বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড মাত্র ০.০৩৮%
হলেও এটাকে কেন পৃথিবীর ভিলেইন বলা হয়? মানুষ আলোর বেগে চলতে পারলে কি টাইম ট্রাভেল সম্ভব?
পৃথিবীতে ভরপুর নিউট্রিনো কণা থাক্লেও কণাগুলোকে কেন মানুষ দেখতে পায় না? মানুষ যদি অদৃশ্য হয় তাহলে কিভাবে দেখবে? পানির ফোটা কেন সবসময়
গোলাকার হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নাজিবুল্লাহ স্যার উনার মনগড়া উত্তর দেন যাতে হাসান মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারে না।
রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে হাসান সিদ্ধান্ত নিল আজ সে স্কুলে যাবে না। তার মাথায় আজ দারুন একটা আইডিয়া এসেছে ।
সন্ধ্যা সাতটা, আজ সে অনেক খুশি কারণ সে প্রথমবারের মত কোন কাজ সফলভাবে করেছে। আজ তার কাজে সহযোগিতার জন্য সে মারফিকে সঙ্গে
নিয়েছিল। কিন্তু পরদিনই স্কুলে গিয়ে হাসানের করা এক্সপেরিমেন্টের কথা সকলকে বলেছিল। সবাই প্রথমে বিশ্বাস না করলেও যখন শেষমেশ তার করা
এক্সপেরিমেন্টের বাস্তব চিত্র পাওয়া গেলো তখন নাজিবুল্লাহ স্যারের ক্লাসটা কমিক মুভিচালিত থিয়েটারে পরিণত হয়েছিল। এই বিষয় সম্পর্কে স্যারের আগ্রহ
দেখে সুরঞ্জন দাঁড়িয়ে হাসানের করা এক্সপেরিমেন্টেটা সাংবাদিকের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল। তার মতবাদ ছিল,
"গতকাল রোজ রবিবার হাসানের মাথায় নতুন একধরনের আইডিয়া এসে ফোটনের গতিতে আঘাত করে। রসায়ন বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়
সে এ কাজ করেছে বলে জানিয়েছে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির উপদেষ্টা মারফি। এক বই দুবছর ব্যবহারের ফলে কিছুটা নোংরা হয়ে যায়। তাই বইকে ধুয়ে
পরিষ্কার করার এক অভিনব পদ্ধতি তৈরি করতে হাসান সাহেব ওরফে পাসান। দুই কেজি পানিতে আধা কেজি ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে এক ধরণের হালকা
দ্রবণ তৈরি করে। সেই দ্রবণে বই পাঁচ মিনিট ডুবিয়ে তারপর রোদে শুকোতে দেয় সে।
ব্লিচিং পাউডারের তিব্র আক্রমনে বইয়ের বাইরের দিকের ময়লা দূরীভূত হয়েছে বলে জানা গেছে।" সুরঞ্জনের বক্তব্য শেষ হতেই আবার হাসির রোল পড়ে গেল
ক্লাসে। তবে হাসানের মনের প্যারাময় মূহুর্তগুলো নিম পাতার রস না হয়ে বরং এক অনুপ্রেরণায় পরিণত হলো নাজিবুল্লাহ স্যারের বক্তব্যে। নাজিবুল্লাহ
স্যার অবাক দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ছোটবেলায় নিউটন ঘুড়িতে হারিকেন বেঁধে ওড়াতে, পাখা বানিয়ে বিল্ডিঙ্গের উপর থেকে লাফ দিয়ে উড়ে
বেড়াতে ব্যার্থ হলেও তার এই অদ্ভুদ আইডিয়াগুলো তাকে সর্বকালের সেরাদের সেরা বানিয়েছিল। ইংল্যান্ড পেয়েছিল এক মহামানবকে। তেমনি বাংলাদেশ
আজ তোর মতই বিজ্ঞানপ্রেমিক ছেলেদেরকে খুঁজছে। পুরো ক্লাস তখন নিশ্চুপ আর হাসানের মনে খেলা করছে আশার নক্ষত্রমন্ডলী।


লেখাঃ মোঃ মাহফুজ আল মামুন।