তখন ২০১৭ সাল প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজে অকাজে হাসপাতালে যাতায়েত ছিলো। তখনকার সময়ের একটা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা।
সেদিন বিশেষ একটা কাজে হাসপাতালে অবস্থান করছিলাম। তখন রাত ১ঃ৩০ বাজে হাসপাতালের বারান্দায় হাটাহাটি করার পর একটা ব্রেঞ্চে বসলাম। তার কিছুক্ষণ পরে একজন বৃদ্ধা মহিলা পাসে এসে বসলেন তখন প্রায় ১:৪০ বেজে গেছে। প্রথমেই আমি জিজ্ঞেস করলাম হাসপাতালে কেনো এসেছেন। তখন উনি হেসে বললেন "এটাই আমার বাড়ি"। কিছুটা অবাক হলাম। তখন কৌতূহল বেড়ে গেলো আমার, আবার জিজ্ঞেস করলাম হাসপাতাল কি কারো বাড়ি হতে পারে? তখন উনি বললেন " আমি প্রায় ২ বছর থেকে এখানেই আছি বাবা, তাই এখন এটাই আমার বাড়ির মতো হয়ে গেছে"। আমি তো তার কথায় রীতিমতো অবাক হয়ে যাচ্ছি। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপর কিছু না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম "আপনার কোনো ছেলে মেয়ে নাই?" উনি তখন কান্নার স্বরে বললেন " আমার ছেলে মেয়ে ৮ জন বাবা ৫ ছেলে, ৩ মেয়ে"।
আমি : তারা আপনার খোজ খবর নেয় না?
এবার তিনি কান্না করেই বললেন " আমার ছেলেরা সবাই অনেক বড় বড় অফিসার। তারা সবাই অনেক শিক্ষিত। আমি তাদের বাসায় গেলে নাকি বউরা নানান কথা বলে, আমি নাকি গ্রামের মানুষ আধুনিক কিছু বুঝি না। আমি নাকি যেখানে সেখানে ময়লা করি। তাদের অনেক সমস্যা করি। একদিন আমি বারান্দায় পান খাচ্ছিলাম তখন এক বউ তার স্বামীকে বলছে" তোমার মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে কি হয়? আমার জীবন টা শেষ করে দিলো। আর সজ্জ করতে পারছি না। হয় তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসো না হয় আমাকে আমার বাবার বাসায় রেখে আসো।" তারপর আমি বুঝতে পারলাম আমি আমার ছেলের বউদের কাছে কতটা বেশি হইছি। তারা তো আমার ঘরের বউ তারা কেনো আমার জন্য বাসার বাইরে যাবে? আমি চলে যাই। কিছুদিন মেয়ের বাসায় ছিলাম সেখানেও একই অবস্থা। তারপর একদিন অসুস্থ হয়ে পরলাম। বড় খোকা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে চলে গেলো। তারপর একদিন সব ছেলে মেয়ে আসছে আমি বাথরুমে যাওয়ার পর কিছু একটা কথা ফিস ফিস করে বলছে। কান পেতে শুনলাম এক ছেলে বলছে "মা তো হাসপাতালে ভালোই আছে। তার উপর আমরা তো সবাই অনেক ভালো জায়গায় আছি। মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলে আমাদের মান সম্মান থাকবে না তার চেয়ে মাকে হাসপাতালেই রেখে দেই। সবাই ভাববে মা অসুস্থ তাই হাসপাতালে আছে। তাতে করে আমাদের বউদেরও কোনো সমস্যা হবে না আর মায়েরও কোনো সমস্যা হবে না। কি বলিস ভাইয়া? " তখন বড় খোকা বললো "খুব ভালো আইডিয়া দিছিস, এটাই করবো এতে আমাদের সবারই মঙ্গল"। সেদিন থেকেই এই হাসপাতালটাই আমার বাড়ি হাসপাতালের সবাই আমার পরিবার। এখানকার মানুষের হাসিতে হাসি কান্নাতে কান্না করি। বাকি জীবন টা হয়তো এখানেই থাকতে হবে।আমার এখন একটাই চাওয়ার মরার পরে যানি তাদের বাবার কবরের পাশে আমাকে করব দেয়"।
ততক্ষণে আমার দু-চোখ ভরে পানি ঝরছে।আবেগ আর ধরে রাখতে পারি নাই। উনার জীবনের গল্প শুনতে শুনতে ৪:৩০ বেজে গেছে তখন, মুয়াজ্জিন সাহেবের আযান শোনা যাচ্ছে। তারপর উনাকে বললাম আমি একটু নামাজ পরে আসি, উনিও বললেন " আমিও নামাজ পরবো বাবা"। এইবলে উনি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। আমিও পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে নামাজের জন্য চলে গেলাম। আসোলে তিনি গ্রামের হলেও উনার কথায় আঞ্চলিকতা বুঝা যায় না, আর কথা গুলো অনেক সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বলছিলেন।

তারপর সকালেই চলে যাই আমার গন্তব্যের উদ্দেশে।


লেখাঃঃ ইসমাইল হোসেন মন্ডল